বাংলাদেশ

ঢাকা নগরের ঐতিহ্যের নতুন অধ্যায়: আড়াই হাজার বছরের পুরনো রাজধানীর সন্ধান!

ঢাকা শহরকে এতদিন ৪০০ বছরের পুরনো রাজধানী হিসেবে জানত সবাই। মোগল সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ সালে ঢাকার গোড়াপত্তন করেছিলেন বলে ইতিহাসে প্রচলিত ছিল। তবে ঢাকার ইতিহাস নিয়ে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন দুর্গ এবং নিদর্শনগুলোর ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, ঢাকার প্রতিষ্ঠা ১৬১০ সালের অনেক আগেই হয়েছিল। ১৪৩০ সালেই এখানে বিশাল এক প্রাসাদ দুর্গ নির্মিত হয়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই স্থান তখনই একটি সমৃদ্ধ রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

বিশেষ চমকের বিষয় হলো, খননে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে, যেগুলো বিশ্লেষণ করে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করছেন, এই জনপদে মানববসতি ছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। এর মানে, ঢাকার বয়স আড়াই হাজার বছরেরও বেশি।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে ‘পুরাতন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন: ঢাকার গোড়াপত্তনের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও এই খননকাজের তত্ত্বাবধায়ক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, সেখানে প্রাপ্ত নিদর্শন এবং গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি জানান, ২০১৭-১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ করা হয়। খননকালে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের বিভিন্ন স্থানে দুর্গের প্রাচীর, কক্ষ, কূপ এবং নর্দমাসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মুদ্রা ও ভাস্কর্য প্রাপ্তি ঘটেছে, যা প্রাচীন ঢাকার স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।

এই প্রাচীন নিদর্শনগুলোর কার্বন-১৪ পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের বেটা ল্যাবরেটরিতে করানোর পর জানা যায় যে, এই দুর্গটি ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের আগেই নির্মিত হয়েছিল। অধ্যাপক সুফি বলেন, ইসলাম খানের ঢাকায় আসার বহু আগেই এখানে একটি প্রাসাদ দুর্গ ছিল এবং সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল। এছাড়া, খননে পাওয়া কয়েকটি গ্লেজড মৃৎপাত্রের টুকরা এবং রোলেটেড মৃৎপাত্র (যা সিরামিকের মতো চকচকে ও সূক্ষ্ম নকশাযুক্ত) থেকে অনুমান করা যায়, ঢাকায় মানববসতি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যেও ছিল। একই ধরনের মৃৎপাত্র প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত করে যে তখন ঢাকার সঙ্গে প্রাচীন সিল্ক রুটের সংযোগ ছিল।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক হাবিবা খাতুন বলেন, “নতুন প্রজন্মকে ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতদিন আমরা মোগল আমলেই ঢাকার ইতিহাসের গর্ববোধ করতাম, কিন্তু এই শহরের আরও সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে।”

সভাপতির বক্তব্যে এশিয়াটিক সোসাইটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক হাফিজা খাতুন বলেন, ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশদ গবেষণায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন অত্যন্ত সহায়ক হবে।

এই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় সহযোগিতা করেছেন মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, মো. মামুন দেওয়ান, মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন, মো. আওলাদ হোসেন এবং চাঁদ সুলতানা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button