রাজনীতি

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে কোন দলের কত লাভ এবং ক্ষতি

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। তবে, এরই মধ্যে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে—নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের। বর্তমানে প্রচলিত সরাসরি ভোটাধিকার ভিত্তিক পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব উঠেছে, যা রাজনীতির ধারা এবং ভোটের বিভিন্ন সমীকরণে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্য

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে বিভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে কথা বলছে। তাদের মতে, এই পদ্ধতি রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করবে এবং সকল দলের প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করবে। তবে বিএনপি শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে, এবং তারা এই পদ্ধতিকে অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে আখ্যা দিয়েছে।

এই পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন দলের অবস্থানের মধ্যে ভোটের বিভিন্ন সমীকরণও ফুটে উঠছে। নতুন এই পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে, কোন দল লাভবান হবে আর কোন দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।

প্রচলিত নির্বাচন বনাম আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি

বর্তমানে বাংলাদেশে সরাসরি ভোটে ৩০০ সংসদীয় আসনে প্রার্থী নির্বাচন হয়। এখানে ভোটাররা সরাসরি তাদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য ভোট দেন, এবং যে প্রার্থী অধিক ভোট পান, তিনিই সংসদে আসন লাভ করেন। তবে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সংসদে প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা নির্ধারণ হবে প্রতিটি দলের মোট ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ, কোনো দল যদি ৪০% ভোট পায়, তাহলে ১০০টি আসনের মধ্যে তারা ৪০টি আসন পাবে।

এই ব্যবস্থায় সরাসরি ভোটে কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হবেন না; বরং একটি দলের মোট ভোটই তাদের আসনের সংখ্যা নির্ধারণ করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে ভোটের চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সম্ভাব্য প্রভাব

বাংলাদেশের প্রচলিত সংসদীয় নির্বাচনে প্রধানত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বেশি সুবিধা পেয়ে এসেছে। জয়ী দলগুলো সংসদের অধিকাংশ আসন পেয়ে থাকে, কারণ সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিতে তারা ভোটের জয় নিশ্চিত করে। তবে আনুপাতিক নির্বাচনে সেই সুবিধা কমে যেতে পারে, এবং ছোট দলগুলোর জন্য একটি সমতার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

নব্বইয়ের দশকে সংসদীয় পদ্ধতির প্রবর্তনের পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার থেকে বেশি আসন লাভ করেছে, বিশেষ করে বিজয়ী দল হিসেবে। এ ব্যবস্থায় তাদের আসন সংখ্যার ওপর একটি প্রভাব পড়তে পারে, যা রাজনৈতিক চিত্রকে নতুন মাত্রা দিতে পারে।

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির সম্ভাব্য সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে সকল দলের জন্য সমতার ভিত্তিতে আসন লাভের সুযোগ থাকবে। এর মাধ্যমে ছোট দলগুলোও নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। তবে এর সাথে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জও। এই পদ্ধতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আনুপাতিক এই নির্বাচন ব্যবস্থা যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ প্রায় একইরকম ভোট পেয়েছিলো। বিএনপি পেয়েছিলো ৩০.৮১ শতাংশ ভোট, আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ৩০.০৮ শতাংশ। তবুও, নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপি ১৪০ আসনে জয়লাভ করে, আর আওয়ামী লীগ পায় ৯৩টি আসন।

অর্থাৎ, ভোটের হার অনেকটা সমান থাকলেও জয়ী দল হিসেবে বিএনপি সংসদে অধিকাংশ আসন দখল করে নেয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই সুবিধা পায় আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬টি আসন পায়, আর বিএনপি ৩৩.৬১ শতাংশ ভোট পাওয়ার পরেও ১১৬টি আসন পায়। ২০০১ সালের নির্বাচনেও দুই দলের ভোটের হার ছিলো প্রায় সমান। বিএনপি পেয়েছিলো ৪০.৮৬ শতাংশ ভোট, আর আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ। কিন্তু ফলাফলে বিএনপি জয়ী হয়ে ১৯৩টি আসন লাভ করে, যেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো মাত্র ৬২টি আসন।

বিশ্লেষকদের অভিমত ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তিনটি নির্বাচন বাদ দিয়ে আগের নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলো সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে লাভবান হতে পারে।” তার মতে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে যে দল বা ব্যক্তি এক ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হতেন, তাদের আসন দখলের সুযোগ কমে যাবে। বরং প্রতিটি দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের ওপর ভিত্তি করে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হবে।

তিনি বলেন, “যদি কোনও ছাত্র সংগঠন বা নতুন দল গড়ে ওঠে এবং তারা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট পায়, তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে তাদের ভালো সম্ভাবনা থাকবে। কারণ এই পদ্ধতিতে এক ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না, বরং ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতেই আসন বরাদ্দ হবে।”

রাজনৈতিক চিত্রের পরিবর্তন

এখন যদি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তবে বড় দলগুলোর একক আধিপত্য কমে গিয়ে ছোট দলগুলো সমানতালে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। আগে যেভাবে জয়ী দলের আসন সংখ্যা অনেকটা বেশি থাকতো, এখন সেটা অন্যান্য ছোট দলগুলোর মধ্যে বণ্টিত হবে। এর ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে, যেখানে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন হবে এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভোটের হার অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার করে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দিক তুলে ধরার সময় এই নতুন পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়। এই প্রস্তাব নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে, বিশেষত ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে জামায়াত যদি নতুন কোনো রাজনৈতিক জোট গঠন করে, তবে তা শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, ভোটের ময়দানেও তাদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।

আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে জামায়াতের সম্ভাব্য লাভ

আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো সংসদে আরও বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ পেতে পারে। যদিও জামায়াত দাবি করছে যে এ ধরনের প্রস্তাব তাদের দলীয় লাভের উদ্দেশ্যে নয়। তাদের বক্তব্য, এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে ছোট দলগুলোও তাদের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে।

জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান, এই প্রস্তাব কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য নয়, বরং “দেশ-জাতির উপকার” সাধনের লক্ষ্যে। তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তাবের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট দলের আলাদা কোনো সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। বরং কোনো দল যদি অল্প ভোটও পায়, তাহলেও আনুপাতিক ভিত্তিতে অন্তত একটি আসন সে দল পেতে পারে। এতে সংসদ একটি কোয়ালিটি পার্লামেন্টে পরিণত হবে এবং জনগণের আসল চাহিদার প্রতিফলন ঘটবে। কারণ এতে সত্যিকার অর্থেই জনগণের ভোটের প্রতিফলন দেখা যাবে।”

বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় জামায়াতের আপত্তি

শফিকুর রহমান আরও বলেন, এখন যে নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন না। তিনি উল্লেখ করেন, “বর্তমান সংসদে এমন কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসছেন, যারা নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারেন না, এমনকি তারা যা বলতে চান সেটিও সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অথচ তারা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নে নিযুক্ত।”

তিনি আরও বলেন, “স্থানীয় সরকারে যারা নির্বাচিত হন, তারাই এলাকায় উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে এসব কাজ এমপিদের হাতে কেন্দ্রীয়ভাবে আটকে আছে। অথচ এমপিদের আসল দায়িত্ব হচ্ছে দেশের জন্য ভালো আইন প্রণয়ন করা এবং মন্দ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু এমপিদের এই দায়িত্বে খুব একটা মনোযোগ নেই। আমরা এই জায়গায় পরিবর্তন চাই।”

আনুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রত্যাশিত পরিবর্তন

শফিকুর রহমানের মতে, আনুপাতিক নির্বাচন চালু হলে সংসদে এমন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন, যারা সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে সক্ষম হবেন। এতে শুধু একটি দল বড় অংশীদার না হয়ে সকল দল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি সংসদে নিজেদের ভোটের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। ফলে সংসদে কণ্ঠস্বরের বৈচিত্র্য এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ আরো জোরালো হবে বলে আশা করা যায়।

জামায়াতের প্রস্তাবিত আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকর হলে দেশের নির্বাচনী চিত্রে একটি নতুন ধারা তৈরি হতে পারে।

ছোট দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বামপন্থী দলগুলো আনুপাতিক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছে। সম্প্রতি সিপিবি এই প্রস্তাবের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের বক্তব্যে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদের মতো অপেক্ষাকৃত নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও একই দাবি জানিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে এমন অনেক ছোট রাজনৈতিক দল আছে, যাদের জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তা সীমিত হলেও নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাদের জনপ্রিয়তা বেশ ভালো। এই কারণে অনেক সময় তারা একটি বা একাধিক আসনে বিজয়ী হতে সক্ষম হয়। তবে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি কার্যকর হলে এসব দলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কারণ যদি তারা সারাদেশে ন্যূনতম ভোট না পায়, তাহলে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

গণঅধিকার পরিষদের মতামত

এই প্রেক্ষাপটে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, ছোট দলগুলোকে টিকে থাকতে হলে জনগণের সমর্থন আদায় করেই আসন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “দেখুন, কোন দলের কী লাভ হবে সেটা পরের বিষয়। আমাদের দৃষ্টিতে দলের লাভ-ক্ষতির চেয়ে রাষ্ট্রসংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন একটি ব্যবস্থা চাই যেখানে গণ-অভ্যুত্থানের পরে কোনও দল এককভাবে ক্ষমতায় আসার কারণে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। এজন্য আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

মি. হক আরও বলেন, “বাংলাদেশে নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর মতামত ও গুরুত্ব সাধারণত খুব একটা মূল্যায়িত হয় না। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা দেখেছি, ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনও দল সরকার গঠন করছে, আর বিপরীতে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দল কার্যত শাসন ব্যবস্থায় কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা চাই কেউ যেন এককভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে না ওঠে। আনুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সকলের মতামতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।”

বিএনপির বিরোধিতার কারণ কী?

ছোট দলগুলো আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও বিএনপি এ ধরনের নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। বাংলাদেশে তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার পরিচালনা করেছে বিএনপি, এবং দলের মূল্যায়নে তারা মনে করছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবারও তাদের জয়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সারাদেশে বিএনপির একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো, সমর্থন এবং ভোটব্যাংক রয়েছে, যা সরাসরি নির্বাচনে তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল দলে রাখে।

বিএনপি মনে করে, আনুপাতিক নির্বাচনের চেয়ে সরাসরি নির্বাচন তাদের জন্য উপযুক্ত, কারণ এতে তারা তাদের প্রচলিত জনপ্রিয়তা এবং ভোটারদের সমর্থনের ভিত্তিতে জয়লাভের সুযোগ পাবে। এজন্য বিএনপি সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা তাদের সাংগঠনিক শক্তির ওপর নির্ভর করে।

আনুপাতিক নির্বাচনে ছোট দলের সম্ভাবনা

যদিও বড় দলগুলো, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় অধিক আসন পেয়ে থাকে, আনুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে জাতীয় পর্যায়ে ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে বলে আশা করা যায়।

বিএনপির ভেতরে আনুপাতিক নির্বাচনের বিরোধিতা

১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪০.৮৬ শতাংশ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পায়। এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দলটির অনেক নেতাই মনে করেন, আনুপাতিক ভোট ব্যবস্থা চালু হলে তাদের এককভাবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যাবে। ফলে দলটির অভ্যন্তরে এই প্রস্তাব নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে, যদিও শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে এমন কিছু বলতে চান না।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর মতো পরিস্থিতি নেই। আপনি এখানে হাইব্রিড সিস্টেমে চলতে পারবেন না। পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে এমন পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এটা কোন ছোটখাটো পরিবর্তন নয়। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থানীয় সরকারের পুরো কাঠামো বদলাতে হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটা বাস্তবায়ন সহজ নয়। তাছাড়া আনুপাতিক ভোটে ঝুলন্ত সংসদের ঝুঁকি থাকে, যা উন্নয়নশীল দেশে সরকার পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। অনেকের মনে হচ্ছে এটি কেবল একটি দলকে পুনর্বাসন করার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে।”

আওয়ামী লীগের আনুপাতিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক যথেষ্ট শক্তিশালী। ১৯৭৩ সালে তাদের ভোটের হার ছিলো ৭৩.২০ শতাংশ। ১৯৭৯ সালে এটি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ২৭.৩৩ শতাংশে। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ পায় ৩০.০৮ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৭.৪৪ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪০.২১ শতাংশ, এবং ২০০৮ সালে তাদের ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮.০৪ শতাংশে। আনুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে এই বিশাল ভোট ব্যাংক আওয়ামী লীগকে তুলনামূলকভাবে বেশ সুবিধা দিতে পারে, তবে দলের ভবিষ্যৎ অংশগ্রহণ নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ আছে।

জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান বলেন, “আওয়ামী লীগকে ‘গণহত্যাকারী’ দল হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তবে বিচারের পরই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। তাই আওয়ামী লীগকে ঘিরে ভয় দেখানোর কিছু নেই।”

গণ অধিকার পরিষদের অবস্থান

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকও মনে করেন, আওয়ামী লীগকে রেখে আনুপাতিক নির্বাচনে যাওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, “গণহত্যাকারী দল হিসেবে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকে প্রথমে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, এরপরই আনুপাতিক নির্বাচনে যাওয়া উচিত। আওয়ামী লীগকে রেখে এ পথে যাওয়া বিপজ্জনক।”

এইসব দলগুলোর বক্তব্য স্পষ্ট, আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু হলে বড় দলগুলোর একক আধিপত্য কমবে এবং ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ বাড়বে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতির বিবেচনার বাইরেও আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশের সার্বিক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হলে সেই কাঠামো পরিচালনার ব্যয়বৃদ্ধি যেমন একটি বড় প্রশ্ন, তেমনি তিনশ’ সংসদীয় আসনের প্রতিটি এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম কে এবং কীভাবে পরিচালনা করবে, সে প্রশ্নও সামনে চলে আসে। কারণ, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখনো তেমন শক্তিশালী নয়, যা আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, আনুপাতিক পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচন না হওয়ায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারীরা পুরোটাই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত হবেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের ভেতরেও গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো দল যে আসন সংখ্যা পাবে, সেই আসনের প্রার্থীরা শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারিত হবেন। এতে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন না হয়ে বরং দলীয় নেতারা প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেবেন, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব তৈরি করতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা অতীতে দেখেছি মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে প্রার্থিতা বিক্রির ঘটনা। আনুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে সেক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধি নির্ধারণেও এই ধরনের কেনাবেচার সুযোগ থেকে যাবে।” বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার নেই, ফলে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন কার্যকর করার আগে প্রাদেশিক পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের সুযোগও নেই।

তাই আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি বাস্তবায়নে দেশের সমগ্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট পরিবেশে নিয়ে আসার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সব মিলিয়ে, আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে এবং রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে এখনো বিস্তৃত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। একইসঙ্গে, ভোটারদের মতামতও এ ব্যাপারে পরিস্কারভাবে যাচাই করা হয়নি। এছাড়া, অন্তবর্তীকালীন কোনো সরকার এ ধরনের নতুন নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে ইচ্ছুক হবে কিনা, সেটাও এখনও অস্পষ্ট। এ সকল বিবেচনাকে সামনে রেখে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবটি দেশের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক এবং সংশয় রয়েই গেছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button