বাংলাদেশ

প্রশিক্ষণরত ৫৯ এসআইকে শোকজ ‘ক্লাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির’ অভিযোগ সারদায়

শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ দেখিয়ে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শক (এসআই)কে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন করে দুই দফায় ৫৯ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। ‘প্রশিক্ষণ ক্লাসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি’ করার অভিযোগে গত সোমবার এবং বৃহস্পতিবার তাঁদের বিরুদ্ধে নোটিশ প্রদান করা হয়।

পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদ স্বাক্ষরিত পৃথক চিঠিতে সোমবার ১০ জন এবং বৃহস্পতিবার ৪৯ জনকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন এসআই নোটিশ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং এই ঘটনায় তাঁদের মধ্যে নতুন করে অব্যাহতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে আজ শুক্রবার সকালে একাধিকবার ফোন করলেও পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত আইজিপি) মাসুদুর রহমান ভুঞার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে তিনি বলেন, “শোকজ বিভিন্ন কারণে দেওয়া হয়। এটা একটি রুটিনমাফিক বিষয়।”

বৃহস্পতিবার ৪৯ জনকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, “আপনি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি রাজশাহীতে ৪০তম ক্যাডেট এসআই ২০২৩ ব্যাচে গত ৫ নভেম্বর থেকে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণরত আছেন। গত ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত চেমনি মেমোরিয়াল হলে প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের ‘আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধারার’ ওপর ক্লাস ছিল। ওই ক্লাসে আইন প্রশিক্ষক হিসেবে পুলিশ পরিদর্শক (নি.) মো. রেজাউল করিম, মো. নজরুল ইসলাম, মো. সিরাজুল ইসলাম ও শেখ শাহীন রাজা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ক্লাসে এসে দেখেন, আপনি শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। রেজাউল করিমসহ অন্যান্য পরিদর্শকেরা বারবার শৃঙ্খলার সঙ্গে বসার নির্দেশনা দিলেও আপনি তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে হইচই করতে থাকেন। পাঠদান চলাকালীন আপনার ক্লাসে কোনো মনোযোগ ছিল না এবং পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলছিলেন।”

নোটিশে আরও বলা হয়, “ক্লাস চলাকালীন আপনার এ ধরনের শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির নিয়ম ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী হওয়ায় মো. রেজাউল করিম বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আপনার এই কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে ১৯৪৩ সালের পিআরবি বিধি অনুযায়ী আপনাকে কেন চলমান মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তার লিখিত ব্যাখ্যা তলবনামা প্রাপ্তির পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হলো।”

এর আগে গত সোমবার ১০ জনকে একই ধরনের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ১৬ অক্টোবর জিমনেশিয়ামে সন্ধ্যায় একটি ক্লাসে বসার সময় হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে।

অধ্যক্ষের পক্ষে নোটিশে স্বাক্ষর করা পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে মুঠোফোন নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে বিষয়বস্তু জানিয়ে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, “২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে শোকজ লেটারের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শোকজ লেটার ইস্যু করা হয় সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে। কতজনকে করা হয়েছে সেটাও জানি না।”

এদিকে, শোকজ পাওয়ার কয়েকজন এসআই জানিয়েছেন, তাঁরা প্রায় এক বছর ধরে নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এত দিন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শোকজ দেওয়া হয়নি। সরকার পতনের পর একের পর এক ঘটনা সাজিয়ে তাঁদের শোকজ পাঠানো হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা, পর্যায়ক্রমে তাঁদের সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশিক্ষণরত একজন এসআই প্রথম আলোকে বলেন, “ক্লাসে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি। এটি একটি নতুন নাটক সাজানো হয়েছে। আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। আমার পরিবার আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, তবে আমি সেভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় নই।”

আরেকজন উপপরিদর্শক বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে যেটা করা হচ্ছে, এটি ঠিক হচ্ছে না। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকলে তদন্ত করে দেখা হোক। আমার বেলায় তো কোনো সুপারিশ ছিল না। আমি নিজ যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। তাহলে আমার ওপর এমন জুলুম কেন?”

হোয়াটসঅ্যাপে কান্নাজড়িত কণ্ঠে একজন এসআই বলেন, “চলতি মাসে ব্যাচের সবাইকে শোকজ করা হচ্ছে। একটি মিথ্যা অপবাদ নিয়ে আমাদের চলতে হবে। এখান থেকে অব্যাহতি পেলে ভবিষ্যতে অন্য কোনো চাকরিও হবে না। ভ্যারিফিকেশনে সব আটকে যাবে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২৩ সালে এসআই পদে নিয়োগের জন্য ৮২৩ জনকে চূড়ান্ত করে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের সারদা পুলিশ একাডেমিতে পাঠানো হয়। ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষে আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের কথা ছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর এসআই পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে পুলিশের নিয়োগ বাতিলের দাবি করে দলটি। এরপরই ২০ অক্টোবর সারদায় এএসপিতে কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়। পরে ২১ অক্টোবর ২৫২ জন এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার খবর পাওয়া যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button